যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পেছনে এক’শ মিলিয়ন ডলারে প্রকল্প

সিলেট

যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পেছনে তিন বছরের প্রচেষ্টা আর এক’শ মিলিয়ন ডলারে প্রকল্প বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ। নিউইয়র্কে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসীদের দেয়া সংবর্ধনায় তিনি বলেন, নিষেধাজ্ঞার নেপথ্যে তিন বছর ধরে বাংলাদেশিদের একটি চক্রের নিয়োগ দেয়া চারটি লবিং ফার্ম কাজ করেছে।

সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আমি মার্কিন প্রশাসন অথবা আমেরিকানদের দোষারোপ করতে চাই না। কারণ, এটা করেছে তারাই, যারা সত্তর সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নৌকায় ভোট দেয়নি, যারা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিলো। ওই গোষ্ঠী ২৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে চারটি লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করেছিল। সেই ভাড়াটে ফার্ম টানা তিন বছর চেষ্টা করেছে কথিত নিষেধাজ্ঞার জন্য।

আইজিপি বেনজীর আহমেদ নিউইয়র্কে আসতে পারবেন কিনা, কয়েকদিন আগেও এমন সংশয়ের কথা বলা হচ্ছিলও। সেখানে তিনি কেবল জাতিসংঘের পুলিশ প্রধানদের সম্মেলনে অংশই নেননি, বরং যোগ দিয়েছেন তার সম্মানে দেয়া এক নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। 

বৃহস্পতিবার নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের কাছে গুলশান টেরেস মিলনায়তনে এই নাগরিক সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের নেতা হিন্দাল কাদির বাপ্পা। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে দেয়া দীর্ঘ বক্তব্যে বাংলাদেশের পুলিশ প্রধান গণতন্ত্র ও মানবিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর দিক দিয়ে নিজেকে চ্যাম্পিয়ন হিসেবে উল্লেখ করেন। বলেন, এরপরও তাকে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। 

ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, আমরা স্বাধীনতা সংগ্রাম করে বিজয়ী হয়েছি। এখন চলছে মুক্তির লড়াই। এ লড়াই অব্যাহত রয়েছে। এই লড়াইয়ে জিততেই হবে। দেশের বিরুদ্ধে, উন্নয়নের বিরুদ্ধে এবং অগ্রযাত্রার বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, তা রুখে দিতে হবে। 

এক সময় মনে করা হয়েছিল যে সামাজিক মাধ্যম সাংবাদিকতায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। কিন্তু বাস্তবে কী দেখছি আমরা, এ প্রশ্ন রেখে আইজিপি বলেন, আশা করা হয়েছিল সমাজের তথ্যচিত্রটি সবিস্তার উঠে আসবে। 

অথচ এখন দেখা যাচ্ছে, যত ভুয়া, আজগুবি তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘২২ জন তথ্য-সন্ত্রাসী রয়েছেন। এঁদের জবাব দিতে হবে। আপনি যে মূল্যবোধের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছেন, সেই বিশ্বাসে যদি চ্যাম্পিয়ন হোন, তাহলে আপনাকেই সেটি পালন করতে হবে।

আইজিপি বলেন, তথ্য-সন্ত্রাসীরা দেশের বিরুদ্ধে, তারা মানবতাবিরোধী অপপ্রচার চালাচ্ছে। তিনি বলেন, নোংরা জিনিস ফেসবুকে দেখামাত্র ফ্লাশ করা দরকার। এর বিরুদ্ধে প্রকৃত সত্যকে উপস্থাপন করতে হবে, তাহলেই মিথ্যার পরাজয় ঘটবে।

আইজিপি বলেন, আজকে আমি যুক্তরাষ্ট্রে এসেছি, যুক্তরাষ্ট্রের বুকে দাঁড়িয়ে আছি। আমি এই দেশে অনেকবার এসেছি, এখানে লেখাপড়া করেছি, চাকরি করেছি। সেই যুক্তরাষ্ট্র আমাকে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। আমাকে তাদের নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। 

আমি পশ্চিমা ভাবধারা ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী একজন মানুষ। সেই মূল্যবোধটি হচ্ছে—গণতন্ত্রের মূল্যবোধ। মানবিকতা ও মানবাধিকারের মূল্যবোধ। আমি তাদের স্বাধীনতায়ও বিশ্বাসী। আমি মানবিকতা ও মানবাধিকারে বিশ্বাস করি, কিন্তু আমার বিরুদ্ধেই এটা হলো।

বেনজীর আহমেদ বলেন, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগটা কি জানেন? সেটা একটি মজার বিষয়। তারা বলছে, ২০০৯ সাল থেকে নাকি দেশে ছয়শ’ লোক গুম হয়েছে। র‌্যাব নাকি গুম করেছে। আমি ভাই ২০০৯ সালে র‌্যাবে ছিলাম না, ২০১০ সালেও র‌্যাবে ছিলাম না। 

আমি ২০১১, ২০১২, ২০১৩ ও ২০১৪ সালেও ছিলাম না। আমি র‌্যাবে ২০১৫ সালে ছিলাম। যদি আমাকে ছয়শ’ লোকের জন্য নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়, তাহলে ওই সময় যারা ছিলেন, তাদের কী হবে? বিষয়টা কী এরকম— বেটা তুই করোনি, তোর দাদা করেছে, এই জন্য তুই দায়ী?

আইজিপি বলেন, আমি এজন্য আমেরিকান সরকারকে দায়ী করবো না। কারণ হচ্ছে, এটা ষড়যন্ত্রকারীদের তিন বছরের ফসল। চারটি লবিং ফার্মকে নিয়োগ করা হয়েছে। প্রতিটি ফার্মকে ২৫ মিলিয়ন (ডলার) করে দেওয়া হয়েছে। এটা একশ’ মিলিয়নের প্রজেক্ট। 

এই নিষেধাজ্ঞা হলো তার ফলাফল। এর সঙ্গে সত্যের কোনও সম্পর্ক নেই। আমি আমেরিকার সরকারকেও কোনও দোষ দেবো না, দায়ী করবো না। আমেরিকান নাগরিকরা তো লবিং ফার্ম নিয়োগ করেনি। কারা এই লবিং ফার্ম নিয়োগ করেছে, তা ওয়েবসাইটে লেখা রয়েছে। 

তারা কারা? তারা তো আমেরিকান না, এখানে তারা বসবাসও করে না। তাই আমেরিকানদের বিরুদ্ধে আমার কোনও অভিযোগ নেই। বরং, আমি মনে করি, আমাদের সঙ্গে আমেরিকানদের একটা শক্তিশালী সম্পর্ক আছে। তাদের নাগরিকদের সঙ্গে আমাদের নাগরিকদের সম্পর্ক আছে।

বেনজীর আহমেদ বলেন, যে সময়ের কথা বলা হয়েছে, তখন আমি আমেরিকায় চাকরি করি। তাহলে তখন তারা আমাকে বের করে দিলো না কেন?’

তিনি বলেন, আমেরিকানদের সঙ্গে আমাদের অনেক গোল সেট করা আছে। আমেরিকানরা সন্ত্রাসবাদের শিকার, আমরাও সন্ত্রাসবাদের শিকার। তাদের সব ঘোষণা ও নীতি রয়েছে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের নীতিও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে। 

বেনজীর আহমেদ বলেন, আমেরিকা ম্যাক্সিকানদের মাধ্যমে মাদকের ভিকটিম, আমরাও মিয়ানমারের মাধ্যমে মাদকের ভিকটিম। আমরা ও আমেরিকা মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। আমেরিকা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, আমরাও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। বিশ্বে আমেরিকা গণতন্ত্রের মডেল। 

আমরাও গণতন্ত্রে উন্নতি করেছি। এটাও আমাদের দুই দেশের একই লক্ষ্য। দুই দেশেরই এরকম অজস্র লক্ষ্য অভিন্ন। আমাদের সামাজিক উন্নয়নে আমেরিকার অবদান রয়েছে। তাই আমি বলবো, এই নিষেধাজ্ঞা যেটা হয়েছে, এটা অবয়বের বাঙালিরা করেছে। 

তারা ফার্ম নিয়োগ করেছে। এই নিষেধাজ্ঞা আমাদের একক কিছু না, এটা সবার। তাই এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে সবাইকে। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। দেশের প্রয়োজনে, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে ও নাগরিকদের প্রয়োজনে- একটি জেনারেশনকে দায়িত্ব নিতে হয়।

আইজিপি বলেন, ছয় শত লোক হারিয়ে গেছে, তারা কোথায়? তাদের নাম কী? তাদের ঠিকানা কী? তাদের কবর কোথায়? মতিঝিলে হেফাজতের প্রোগ্রামে নাকি তিন হাজার লোক মারা গেছে। পরে আমরা তাদের জিজ্ঞাস করলাম- যারা মারা গেছে তাদের নাম, ঠিকানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম দেন। তারা দিতে পারলো না।

সংবর্ধনায় তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ এখন ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে, এমন সময়ে কখনো কখনো কাউকে না কাউকে দায়িত্ব নিতে হয়। দেশের প্রয়োজনে, নাগরিকের স্বার্থে, মানবিকতার প্রশ্নে কখনো কখনো প্রজন্মকে দায়িত্ব নিতে হয়। স্বাধীনতার সংগ্রাম করে বিজয়ী হয়েছি। এখন চলছে মুক্তির লড়াই। এ লড়াই অব্যাহত আছে। এই লড়াইয়ে জিততে হবে।

বাঙালির ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বেনজীর আহমেদ বলেন, বঞ্চনা, জুলুম-নির্যাতন, শোষণের কবলে ছিলেন বাঙালিরা। কখনো শাসন ক্ষমতা পাননি। অথচ এই সময়ের মধ্যে চার জন বাঙালি নোবেল পুরস্কার জয়ী হয়েছেন। 

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাঙালিরা রাজনৈতিকভাবে নেতৃত্ব পাননি। বঙ্গবন্ধু সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন এবং তার কন্যা শেখ হাসিনাও একই চেতনায় বাংলাদেশকে অনেক দূর এগিয়ে এনেছেন। তার বিচক্ষণ নেতৃত্বে বাংলাদেশ অব্যাহতভাবে এগিয়ে চলছে।

তিনি বলেন, বাঙালির চার হাজার বছরের ইতিহাসে আমরা নিজেরা নিজেদের কখনও শাসন করিনি। অনেকে সেন, পাল ও নবাব বংশের কথা বলেন। আসলে তারা বাঙালি ছিলেন না। অথচ এই বাংলা ছিল শস্য শ্যামল ও শস্যভাণ্ডার। চার মাস কৃষকরা চাষাবাদ করতো। হিমালয় থেকে আসা পলির কারণে এই জমি ছিল উর্বর। 

আইজিপি বলেন, বাঙালি হলো গোল্ডফিশ মেমোরি। আমাদের ১৯৭১ সালের আগের ইতিহাস কী ছিল, তা আমরা কেউ মনে করি না। ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের চেহারা কেমন ছিল? যাদের মনে আছে, তারা বলতে পারবেন। ১৯৭১ সালে যখন দেশ স্বাধীন হয়, তখন পশ্চিমের বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদরা বলেছিলেন এই দেশ টিকবে না। 

তাদের যুক্তি ছিল— সাত কোটি মানুষের খাদ্য বাংলাদেশ উৎপাদন করতে পারবে না। প্রতিবছর ৬ থেকে ১৮ লাখ টন খাবার প্রয়োজন। এজন্য ধারাবাহিকভাবে আমাদের ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষ হামলা করতো। কারণ, আমরা উৎপাদন করতে পারতাম না। আমরা প্রকৃতির ওপর নির্ভর ছিলাম। যে বছর বন্যা হয়েছে ফসল হয়নি, যে বছর খরা হয়েছে ফসল হয়নি। তাই আমরা ১৯৭১ সাল বা তার আগে খাবার উৎপাদন করতে পারতাম না।

পুলিশের আইজি আরও বলেন, সেই অর্থনীতিবিদদের আরও যুক্তি ছিল, এ দেশে রফতানির কোনও পণ্য নেই, শিল্প কারখানা এবং আমাদের খনিজসম্পদ নেই। তাই এই দেশ টিকবে না। ১৯৭২ সালে যে বাজেট ঘোষণা করা হয়েছিল, তা ছিল কৃষি খাতনির্ভর। কিন্তু এখন কৃষি খাতনির্ভর বাজেট কমতে কমতে ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে।’

তিনি বলেন, সেসব অর্থনীতিবিদের মুখে ছাই দিয়ে, কেবল ছাই দিয়ে না, চুনকালি দিয়ে আমাদের অর্থনীতি কোথায় চলে গেছে। করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ না এলে আমাদের জিডিপি ১০ শতাংশ থাকতো এখন। 

কারণ, করোনার আগে আমাদের জিডিপি ছিল ৭.৫ শতাংশ। এটা বিশ্বব্যাংকের কথা। ২০৩০ সালে মধ্যম আয়ের দেশ, ২০৪০ সালে আধুনিক দেশে উন্নতি হওয়া কথা রূপকথা না। এটা বাস্তবতা। আমরা অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারি। আমরা মাথা উঁচু করেই বসবাস করবো।

আইজিপি বলেন, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে স্বাধীন করার আরেকটি দর্শন হলো—ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত করা। আমরা দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছি। বিশ্বে আমরা ৩৬তম বড় অর্থনৈতিক দেশ। কয়েক বছরের মধ্যে ২৪তম দেশে রূপান্তরিত হবো।

আরও পড়ুন: বেশি ভাড়া নেয়ায় রাজধানীতে আটটি বাসকে জরিমানা

তিনি বলেন, দেশ, দেশের মানুষ, উন্নয়ন, উন্নয়ন অগ্রযাত্রার বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র হয়েছে, তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। এই বাঙালি জাতি যখন ন্যায্যতার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করেছে, তখনই তারা বিজয়ী হয়েছে।

উল্লেখ্য, ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‌্যাব ও এর সাবেক-বর্তমান ৭ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়। 

এই নিষেধাজ্ঞার ফলে বাংলাদেশের শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা বেনজীর আহমেদ আর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অনুমতি পাবেন না বলে ধারণা করা হয়েছিল। 

তবে, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিয়েই জাতিসংঘের পুলিশ প্রধান সম্মেলনে অংশ নিতে বর্তমানে নিউইয়র্কে অবস্থান করছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ।

Facebooktwittergoogle_plusredditpinterestlinkedinmail

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *